রেলের ১৫ হাজার শূন্য পদ পূরণের সিদ্ধান্ত, ৮৫ ভাগ কোটায়
দীর্ঘদিন পর রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৫ হাজার শূন্য পদে লোকবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী তিন বছরে এসব নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। এ লক্ষ্যে ৬ অক্টোবরের মধ্যে ২৩৫টি সহকারী স্টেশন মাস্টার পদে আবেদনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট পদে নিয়োগ হবে পর্যায়ক্রমে। এবারও ১৫ ভাগ মেধা, ৪০ শতাংশ পোষ্য এবং ৪৫ ভাগ অন্যান্য কোটায় নিয়োগ হবে।
এ সুযোগে একটি চক্র প্রভাবশালীদের ডিও লেটার সংগ্রহসহ নানা ধরনের তদবির লবিংয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় রেলে ‘কালোবিড়ালের’ দাপটে এবারের নিয়োগও যথাযথভাবে হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দুর্নীতি বন্ধে শূন্য সহনশীলতা কঠোরভাবে কার্যকর না করলে এই বিড়ালের দৌরাত্ম কমবে না।
বর্তমানে রেলওয়েতে ২৩ হাজার পদে লোকবলের ঘাটতি আছে। একই সঙ্গে চাকরির মেয়াদ শেষে নিয়মিত অবসরে যাচ্ছেন অনেকে। সব মিলে শূন্য পদের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ নিয়মিত নিয়োগ হচ্ছে না। ফলে ঘাটতি নিয়ে চলছে রেল। এ অবস্থায় জনবলের অভাবে স্টেশন বন্ধসহ ভেঙে পড়ছে ট্রেন চলাচল। স্থায়ী নিয়োগে দুর্নীতির কারণে চুক্তিতে কাজের প্রসঙ্গ এসেছে। তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও দুর্নীতি শাখা বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ায় লোকবল আরও জরুরি। কাজেই চাহিদা মেটাতে দীর্ঘদিন পর নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে অনিয়ম বন্ধে রেলের কর্মকর্তা ছাড়াও নিয়োগ কমিটিতে পিএসসির প্রতিনিধি যুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রোববার রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রেলে লোকবল নিয়োগে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। যে কোনো মূলে দ্রুত নিয়োগ শেষ করতে হবে। লোকবলের অভাবে ট্রেন পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটছে। নতুন প্রকল্পের সুফল পেতে শূন্য পদ পূরণ জরুরি। ১৫ হাজার পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, নিয়োগের বিষয়ে এমপি-মন্ত্রীদের ডিও লেটার আসতেই পারে কিন্তু চাকরি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে।’ ‘চাকরির জন্য কেউ যদি অর্থ লেনদেন করে, চাকরি পাইয়ে দেবেন-এমন প্রতিশ্র“তি দিয়ে টাকা নেয় সেজন্য আমরা দায়ী থাকব না। সংশ্লিষ্টদের কেউ দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পোষ্য কোটায়ও লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল তৎকালীন রেলপথমন্ত্রীর এপিএসের গাড়িতে নিয়োগ বাণিজ্যের ৭০ লাখ টাকা পাওয়ায় দেশজুড়ে শোরগোল শুরু হয়। ১৬ এপ্রিল ‘নিয়োগ বাণিজ্যে অর্থ কেলেঙ্কারির’ দায় কাঁধে নিয়ে পদ থেকে সরে দাঁড়ান সেই সময়ের রেলপথমন্ত্রী। এছাড়া ওই দুর্নীতি কাণ্ডে রেলওয়ে জিএম ইউসুফ মৃধাসহ বেশ কয়েকজন রেল কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারির মধ্যে ২৩৫ জন সহকারী স্টেশন মানুষ নিয়োগ সম্পূর্ণ করা হবে। এছাড়া আগামী ৩ বছরের মধ্যে ১৫ হাজার লোকবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক বছরের মধ্যে ২৫০ জন সহকারী লোকো মাস্টার, ৩০০ পয়েন্টম্যান, ৪৫০ খালাসি, ৮০০ গেটকিপার নিয়োগ হবে। এক বছরে ২০৩৫ জন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এসব পদে ৮৫ শতাংশ নিয়োগ হবে কোটার ভিত্তিতে। বাকি ১৫ শতাংশ মেধা যাচাই করে নিয়োগ দেওয়া হবে।
৮৫ ভাগের মধ্যে রেলওয়ে পোষ্য কোটা ৪০ শতাংশ নিয়োগ হবে। অবশিষ্ট ৪৫ শতাংশ হবে আনসার ও ভিডিপি, প্রতিবন্ধী ও এতিম, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, জেলা এবং নারী কোটায়। পোষ্য কোটা নিয়ে খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগে নানান প্রশ্ন উঠেছে।
এবারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন মহলের তদবির, ডিও লেটার পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। একই সঙ্গে পরীক্ষায় জালিয়াতি, নম্বর কমবেশি দেওয়াসহ আর্থিক লেনদেন প্রদান বিষয়টিও বারবার উঠে আসে। অনিয়ম বন্ধে নিয়োগ কমিটিতে পিএসসির প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, পোষ্যসহ অন্যান্য কোটায় চাকরি পাওয়া লোকজন রেলে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারছে না। রেল খুবই টেকনিক্যাল বিষয়, এখানে উনিশ থেকে বিশ হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে-ঘটছেও। মেধার ভিত্তিতে রেলে চাকরি পাওয়ার সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে কোটা।
তবে এক্ষেত্রে অন্য মতও আছে। কেন্দ্রীয় রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, পোষ্য কোটা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। এই কোটা বাতিলের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সম্ভব হয়নি। আমরা মনে করি পোষ্য কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। পোষ্য কোটায় মেধা যাচাইয়ের সুযোগ নেই এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অভিযোগ সত্য নয়। এ কোটায়ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ভাইভায় সুযোগ দেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পোষ্য কোটায় চাকরি দেওয়া হয়।
এর আগে সেই ২০১২ সালের পর পর্যায়ক্রমে প্রায় ১৫ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়োগের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশতাধিক মামলা করেছে চাকরিবঞ্চিত প্রার্থীরা। এতে মাসের পর মাস আটকে ছিল নিয়োগ প্রক্রিয়া। ট্রেন পরিচালনা প্রায় ভেঙে পড়ছিল। পরে বাধ্য হয়ে নানা কৌশলে মামলার বাদীদের সমন্বয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো সম্পূর্ণ করা হয়। এরপর অনেক দিন রেলে নিয়োগ বন্ধ ছিল। সর্বশেষ চলতি মাসে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় রেল।
রেলওয়ে মার্কেটিং ও করপোরেট প্লানিং বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় বিশেষ করে ট্রেন পরিচালনায় মারাÍক বিঘ্ন ঘটছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ওপর ভরসা করে ট্রেন পরিচালনা করতে হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
এবার দ্রুত নিয়োগ সম্পূর্ণ করতে সম্প্রতি একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একজন করে প্রতিনিধি যুক্ত করা হয়েছে। আর কমিটির আহ্বায়ক হচ্ছেন-রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এমঅ্যান্ডসিপি) একেএম আব্দুল্লাহ আল বাকী।
এ কর্মকর্তা জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করতে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি-আশা করি ২৩৫ জন সহকারী স্টেশন মাস্টার নিয়োগ আগামী ফেব্র“য়ারি মধ্যে শেষ করতে পারব। কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি যাতে না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ খেয়াল রাখা হবে। কোনো চাপে পড়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি করা হবে না বলেও তিনি জানান।সূত্র: যুগান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত