পদোন্নতি নিয়ে মহাসংকটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা

| আপডেট :  ০৩ এপ্রিল ২০২২, ১১:৫১  | প্রকাশিত :  ০৩ এপ্রিল ২০২২, ১১:৫১

বিদ্যালয়ের পাঠদানসহ শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার নেতৃত্ব দেন প্রধান শিক্ষক। যদিও বছরের পর বছর প্রধান শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ পদটি শূন্য রেখেই চলছে দেশের কয়েক হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক কার্যক্রমের নেতৃত্ব ও তদারকিতে বেশ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১২ সালের পর আর সরাসরি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। বিলম্বিত হয়েছে সহকারী শিক্ষকের পদোন্নতিও। কয়েক বছর আগে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া শুরু হয়েছে প্রধান শিক্ষক। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে শূন্য পদ দিয়ে অনলাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালানো গেলেও, নিয়মিত স্কুল শুরু হওয়ায় পর দেখা দিতে শুরু করেছে নানা সমস্যা। একদিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক না থাকায় প্রশাসনিক কাজে তৈরি হচ্ছে স্থবিরতা, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী শিক্ষক না থাকায় পাঠদান কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলগুলো। ফেনী, সাতক্ষীরা, বগুড়া ও বরিশালের তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন ধরে জনবল নিয়োগ ও পদোন্নতি বন্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে।

ফেনীর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য বলছে, ফেনীর ছয় উপজেলায় ৫৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৩ জন প্রধান শিক্ষক ও ২২১ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে সাতক্ষীরায়ও। সাতক্ষীরা জেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলায় ১ হাজার ৯৫টি সরকারি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে ১১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে, যা মোট স্কুলের ১০ শতাংশেরও বেশি।

বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১ হাজার ৬০১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। জেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তহমিনা খাতুন জানান, এর মধ্যে ৩০০টি পদ শূন্য রয়েছে।

অন্যদিকে বরিশাল জেলার ১০ উপজেলার ১ হাজার ৫৯২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৪২টিতেই নেই প্রধান শিক্ষক। জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার পাতারহাট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষার্থীর অনুকূলে ২১ জন শিক্ষকের পদে রয়েছেন ২০ জন। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি শূন্য রয়েছে গত তিন বছর। একইভাবে আরো ২৪১টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন।

২০১৯ সালের এপিএসসি অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মোট শূন্য পদ ৭ হাজার ১৮টি। সহকারী শিক্ষকের মোট শূন্য পদ ২১ হাজার ৮১৪টি। তথ্যমতে, প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদের মধ্যে পদোন্নতিযোগ্য ৪ হাজার ১৬৬ জন (৬৫ শতাংশ) ও সরাসরি নিয়োগযোগ্য ২ হাজার ৮৫২ জন (৩৫ শতাংশ)।

বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাকালে শ্রেণী কার্যক্রম নিয়মিত না থাকায় শিক্ষক কর্মচারী সংকট থাকলেও তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। গত ১৪ মার্চ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি চালুর ঘোষণা করা হলে পরিপূর্ণ জনবল কাঠামো জরুরি হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদে জনবল কম থাকায় প্রশাসনিক ও শ্রেণী কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধান শিক্ষক না থাকায় সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে জোড়াতালির মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করায় তাতে গতি আসছে না। শিক্ষকশূন্যতাসহ নানাবিধ সংকটের কারণে জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তি করাতে আগ্রহ হারাচ্ছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। আর নিম্নবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি হলেও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও তত্ত্বাবধান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় দ্রুত শূন্য পদে প্রধান ও সহকারী শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবিড় তত্ত্বাবধান বাড়াতে না পারলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংকট চরম আকার ধারণ করতে পারে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষকের শূন্যতায় অনেকটা দায়সারাভাবে সহকারী শিক্ষকরা পাঠদানের নামে সময় পার করছেন। শিক্ষক সংকটে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পড়ালেখা নিয়েও হতাশায় রয়েছেন তারা। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনেও পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো. আনিসুর রহিম জানান, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষিত নাগরিক গড়ে উঠবে না। তিনি দ্রুত শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। এছাড়া শিক্ষা খাতে আরো বেশি বাজেট রাখার আহ্বান জানান।

সাতক্ষীরা জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবু হেনা মোস্তফা কামাল মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি স্কুল পরিচালনা ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, উচ্চ আদালতে এ-সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন থাকায় নতুন করে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। তবে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক ৬৫ ভাগ সহকারী শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। ৩৫ ভাগ নতুন নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পদোন্নতি বন্ধ থাকায় দিন দিন প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর করোনা মহামারী শুরু হওয়ায় নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় নিয়োগ কার্যক্রমের বাকি ধাপগুলো শুরু হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ সম্পন্ন হলে শিক্ষক সংকট কেটে যাবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।

রংপুর সিটি করপোরেশনের ভেতরে অবস্থিত এস আর হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে কর্মরত একমাত্র শিক্ষক নাদিরা বেগম। একমাত্র হওয়ায় তিনিই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক; তিনিই আবার প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস টিচার।

কীভাবে একমাত্র শিক্ষক হলেন- জানতে চাইলে নাদিরা বেগম বলেন, প্রধান শিক্ষকসহ আমরা পাঁচজন শিক্ষক ছিলাম। প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম গত বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর দুই সহকারী শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম ও আবদুর রাজ্জাক খান অবসরে যান। অপর সহকর্মী ফারহানা রুবিনা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন।

মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে বিদ্যালয়টি চললেও সেখানে কাউকে পদায়ন করতে পারেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কারণ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০২০ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি বন্ধ রয়েছে। নাদিরা বেগম জানান, তাদের স্কুলের বিষয়টি মন্ত্রণালয়েও জানানো হয়েছে। শিগগির শিক্ষক দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

একইভাবে রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজিনা মমতাজ জাহান গত বছরের ২১ নভেম্বর অবসরে যান। তার অবসরের পর এ বিদ্যালয়ে কোনো প্রধান শিক্ষক দেওয়া যায়নি। চার মাস প্রধান শিক্ষক ছাড়াই চলছে বিদ্যালয়টি। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক কাজগুলো চালিয়ে নিচ্ছেন একজন শিক্ষক। বাকি চারজন শিক্ষক মিলে ৪৮৫ জন ছাত্রছাত্রীকে প্রতিদিন পাঠদান করছেন। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও চান দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি শুরু হোক। সহকারী শিক্ষিকা রওশান আরা বীথি বলেন, পাঠদানে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। বদলি শুরু হলে অন্যত্র থেকে শিক্ষক এনে সমন্বয় করা গেলে সমস্যার সমাধান হবে।

জানা যায়, দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০২০ সালের ২৬ অক্টোবর শিক্ষকদের বদলি বন্ধের আদেশ জারি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। দুই বছরে অন্তত সাড়ে ১১ হাজার শিক্ষক অবসরে বা মারা গেছেন। এসব পদ শূন্য হয়েছে। একটি বিদ্যালয়ে সাধারণত একজন প্রধান শিক্ষক ও পাঁচজন সহকারী শিক্ষক থাকেন। পাঁচ শিক্ষকের কেউ আবার প্রেষণে, ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স করতে অথবা প্রশিক্ষণে থাকেন। এতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা আরও দুই থেকে তিনজন কমে যান। সারাদেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই এখন শিক্ষক সংকট রয়েছে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত